Recents in Beach

মুলা শাক চাষ পদ্ধতি

মুলা শাক চাষ পদ্ধতি: একটি লাভজনক ও পুষ্টিকর সবজির চাষাবাদ


ভূমিকা:
মুলাশাক শুধু মুলোর একটি উপজাতই নয়, এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর leafy vegetable বা পাতা সবজি। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, কে, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাদের পাশাপাশি এর চাষ পদ্ধতি সহজ এবং কম সময়ে ফলন পাওয়া যায়, যা কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল হিসেবে পরিচিত। শহর ও গ্রাম উভয় জায়গায় ছাদকৃষি বা ক্ষেত- দুই জায়গাতেই এই শাকের চাষ সফলভাবে করা সম্ভব। আসুন জেনে নিই মুলা শাকের সফল চাষ পদ্ধতির প্রতিটি ধাপ।


১. উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ু:

· মাটি: মুলা শাক প্রায় সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। তবে দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি যেখানে জলের নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো, সেখানে এর ফলন সবচেয়ে ভালো হয়। মাটির pH মান ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে হওয়া উচিত।
· জলবায়ু: মুলা শাক শীতকালীন শাক হলেও এটি শীত ও গ্রীষ্ম - প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে শীতকাল (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) হলো মুলা শাক চাষের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে পাতা বেশি নরম, সতেজ ও সুস্বাদু হয়।

২. জাত নির্বাচন:

মুলা শাক আসলে মুলো গাছেরই পাতা। তাই যে কোনো মুলোর জাত থেকেই শাক সংগ্রহ করা যায়। তবে কিছু জাত বিশেষভাবে শাকের জন্য উন্নত করা হয়েছে, যেগুলোতে গাছ বেশি পাতা তৈরি করে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাটা যায়। স্থানীয় কৃষি দপ্তর বা বিশ্বস্ত বীজের দোকান থেকে শাক উৎপাদনের জন্য উপযোগী জাতের বীজ সংগ্রহ করা উচিত।

৩. জমি তৈরি ও সেচ ব্যবস্থা:

· জমি তৈরি: প্রথমে জমিকে ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে নরম ও সমতল করতে হবে। মাটি যেন ঝুরঝুরে হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে ৫-১০ টন ভালো পচা গোবর বা জৈব সার প্রতি হেক্টর হিসেবে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ে।
· বেড তৈরি: ভালো জলনিকাশের জন্য জমিতে ১ থেকে ১.৫ মিটার চওড়া এবং সুবিধামতো দৈর্ঘ্যের বেড তৈরি করা উত্তম। এতে গাছের গোড়ায় জল জমে থাকার সম্ভাবনা কমে।
· সেচ: বীজ বপনের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। মাটিতে রসের অভাব দেখলে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন অতিরিক্ত জল না জমে। সাধারণত শীতকালে ৭-১০ দিন পরপর সেচ দিলেই চলে।

৪. বীজ বপনের নিয়ম:

· বীজের হার: শতক প্রতি প্রায় ২০০-২৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। এক হেক্টর জমির জন্য ৫-৬ কেজি বীজ যথেষ্ট।
· বপনের সময়: সারি করে বীজ বপন করা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে এবং সারিতে ৫-৭ সেন্টিমিটার দূরে দূরে বীজ বপন করতে হবে।
· বপনের গভীরতা: বীজ খুব গভীরে বপন করা উচিত নয়। মাটির ১-২ সেন্টিমিটার নিচে বীজ রাখলেই যথেষ্ট।
· ছাদে বা টবে চাষ: ছাদকৃষির জন্য যে কোনো টব, ড্রাম বা প্লাস্টিকের কন্টেইনারে ভালো মিশ্রসার (মাটি, কম্পোস্ট, কোকোপিট) নিয়ে সরাসরি বীজ ছিটিয়ে দিলেই হবে। বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা গজানোর পর কিছুটা পাতলা করে দিতে হবে (থিনিং)।

৫. সার ও পরিচর্যা:

· সার প্রয়োগ: জৈব সার ছাড়াও রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে।
  · ইউরিয়া সার: বীজ গজানোর ১৫-২০ দিন পর এবং প্রথম কাটার পরপরই প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ কেজি হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিলে গাছ দ্রুত বাড়ে এবং পাতা গজায়।
  · অন্যান্য সার: জমি তৈরির সময় এমওপি (MOP) ও টিএসপি (TSP) সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী সারের পরিমাণ ঠিক করা ভালো।
· অন্যান্য পরিচর্যা:
  · সরিষা: চারা গজানোর পর বেশি ঘন হয়ে গেলে কিছু চারা তুলে ফেলতে হবে (থিনিং) যাতে বাকি গাছগুলো ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
  · নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন: নিয়মিত জমি থেকে আগাছা তুলে ফেলতে হবে। এতে গাছের খাদ্য ও আলো বাতাস পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
  · পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন: মুলা শাক সাধারণত তেমন রোগ-পোকার আক্রমণ হয় না। তবে কখনও কখনও জাবপোকা, লিফ মাইনার বা পাতার দাগ রোগের সমস্যা হতে পারে।
    · জৈব পদ্ধতি: নিমের তেল বা সাবান-পানির দ্রবণ স্প্রে করে জাবপোকা দমন করা যায়।
    · রাসায়নিক পদ্ধতি: সমস্যা বেশি হলে স্থানীয় কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে শাক কাটার কমপক্ষে ১০-১৫ দিন আগে কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬. ফসল তোলা ও ফলন:

· ফসল তোলার সময়: বীজ বপনের মাত্র ২৫-৩০ দিন পর থেকেই মুলা শাক কাটা শুরু করা যায়। গাছ যখন ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এবং পাতাগুলো সতেজ ও সবুজ দেখায়, তখনই কাঁচি বা ধারালো ছুরি দিয়ে মাটির উপরে থেকে পাতা কেটে নিতে হবে।
· কৌশল: গোড়াসহ না তুলে শুধু উপরের অংশ কেটে নিলে গাছ আবার নতুন পাতা গজায় এবং একই গাছ থেকে ২-৩ বার শাক সংগ্রহ করা সম্ভব। এতে ফলন বাড়ে।
· ফলন: সঠিকভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ১৫-২০ টন পর্যন্ত মুলা শাক উৎপাদন সম্ভব। একটি ছোট টব থেকেও পরপর কয়েকবার কাটার পরও প্রচুর শাক পাওয়া যায়।

৭. সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ:

· সংরক্ষণ: মুলা শাক খুব নরম ও দ্রুত নষ্ট হওয়া একটি পণ্য। কাটার পর (তড়িত্) ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পলিথিন ব্যাগে বা বাঁশের ঝুড়িতে ভরে বিক্রির জন্য পাঠানো যায়। ফ্রিজে ২-৩ দিন তাজা রাখা সম্ভব।
· বাজারজাতকরণ: স্থানীয় বাজার, হাট, এমনকি সুপার শপেও মুলা শাকের ভালো চাহিদা রয়েছে। তাজা ও সবুজ পাতা বাজারজাত করতে পারলে দাম ভালো পাওয়া যায়।


উপসংহার:

মুলা শাক চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক, কম খরচ ও কম সময়ের কৃষি উদ্যোগ। অল্প জায়গায়, অল্প পরিচর্যায় দ্রুত ফলন পাওয়া যায় বলে ছাদকৃষ (উদ্যোক্তা) থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কৃষক - সবার জন্যই এটি একটি আদর্শ ফসল। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই শাক চাষ করে যেমন নিজের পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যায়, তেমনি বাজারেও ভালো দামে বিক্রি করে আয় বাড়ানো যায়। তাই, আসুন আমরা সবাই এই সহজলভ্য কিন্তু গুণে ভরপুর মুলা শাকের চাষে আগ্রহী হই এবং একটি স্বাস্থ্যকর ও লাভজনক কৃষির দিকে এগিয়ে যাই।

Post a Comment

0 Comments